সন্তান
-সঞ্চিতা রায়
‘মিসদিদা এই নাও আমাদের বাগানের ফুল”। স্মিতার সকালটা একরাশ ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠলো। তাঁর ড্রইংরুমও একদল ফুলের কলকাকলিতে মেতে উঠেছে। সমস্বরে ওরা বলছে ‘শুভ সকাল মিস্ দিদা’। স্মিতা একমুখ হাসি নিয়ে বলছেন ‘শুভ সকাল আমার মিষ্টি ছোট্ট সোনারা’। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন ক্লাসের শিশু কিশোর কিশোরীর কলরবে মুখরিত ঘর। এদের বেশীর ভাগই পথশিশু বা বিভিন্ন বস্তি থেকে এসেছে। স্মিতা ওদের পড়ায়, বই খাতা, কলম কিনে দেয়। মিস্ দিদা ওদের বড় কাছের, বড় ভালবাসার মানুষ। ‘কাল ওষুধ খেতে ভুলে গিয়েছিলে, আজ আগে ওষুধ খাও‘। শেফালীর গলা। শেফালীরা তিন প্রজন্ম ধরে এবাড়িতে কাজ করে, শেফালীর দাদাশ্বশুর শিবমকে স্মিতার শ্বশুর এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর ছেলে, তাঁর নাতি সবাই এই বাড়ির নানা কাজের সাথে যুক্ত। শেফালী শিবমের নাতবৌ। এখন শিবম আর তাঁর স্ত্রী আর নেই। শেফালিরা বাকি সবাই এই বাড়ির বিভিন্ন কাজে বহাল আছে। এদের সাথে স্মিতার আত্মিক সম্পর্ক। আত্মার কাছাকাছি মানুষই যে প্রকৃত আত্মীয় হয়, আর অনেক সময় তা রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশী হয়,এই সম্পর্ক তার প্রমাণ। ‘খেয়ে নেব ক্ষণ’। খেয়ে নেব না এখনি খাও’। ‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা তোর শাসনের ঠেলায় আর পারি না।’
ড্রইং রুমের ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্মিতা। মাঝখানে শেফালী এসে জল খাবার খাইয়ে, ওষুধ খাইয়ে গেল। আজ সন্ধ্যায় আবার অভাবী মেয়েদের আঁকা, সেলাই শেখাবেন। কোনো কিছুর জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেন না তিনি। এদের যখন যা মনে হয় অল্প গুরুদক্ষিণা এরা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে কারুর বাড়ির গরুর দুধ, কারুর মুরগির ডিম ইত্যাদি থাকে। এই বাড়িতে স্মিতা বউ হয়ে এসেছিল মাত্র উনিশ বছর বয়সে। তাঁর শ্বশুর পরিচয় পর্বের সময় বাগানে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বলেছিলেন, ‘এরা সবাই এই বাড়ির সদস্য। এদেরও যত্নে রাখবে মা’। বাগান জুড়ে আম, কাঁঠাল, লেবু, পেয়ারা, আরো অনেক বড় গাছ, কত কত ফুলের গাছ দেখে স্মিতার মন ভরে গিয়েছিল। সেই থেকে এদের পরিচর্চা করেন স্মিতা। শ্বশুর শাশুড়ী নেই, বরও নেই কিন্তু গাছেরা আজও প্রাণ স্মিতার। বিয়ের দুই বছর পর কোলে আসে সৌমেন। ধীরে ধীরে সৌমেন বড় হয়। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে কাকলিকে। এরপর মিতুন, স্মিতার নাতনী আসে এ ঘর আলো করে। মিতুন তার ঠাম্মির প্রাণ। আধুনিকা কাকলি ঠাম্মির ঘরে মেয়ের বেশীক্ষণ থাকা পছন্দ করে না। মিতুন কিন্তু ছোটো থেকেই ঠাম্মি অন্ত প্রাণ। মিতুন ধীরে ধীরে চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে গেল। একদিন সৌমেন এসে স্মিতাকে বললো, ‘মা চলো এই বাড়িটা আমরা ফ্ল্যাট করে ফেলি, অনেক টাকাও পাবো, দু’টো ফ্ল্যাট নেব, একটাতে তুমি তোমার মত থাকবে, অন্যটাতে আমরা। যে যার নিজের মত স্বাধীন থাকবো। বাবা তো বাড়ি তোমার নামে করে গেছেন, তাই তোমার সই লাগবে’।
‘কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে এ বাড়ি বিক্রী হবে না। তোমার ঠাকুরদাদা যে বাগান আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছেন সেই বাগানের গাছেরাও আমার সন্তানতুল্য। আমি এ বাড়ি বিক্রী হতে দেব না।’ দৃঢ় কন্ঠে বললেন স্মিতা।
‘এই আবেগের কোনো মানে হয় না’ কাকলি বলে ওঠে। সেটা তোমার মত, আমার কোনো দায় নেই এই ব্যাপারে। রাগে গজগজ করতে করতে সৌমেন কাকলি বলে ‘এই বাড়িতে আমাদের কোনো প্রাইভেসী নেই, আমাদের বড় অসুবিধা হয়’।
‘তবে নিজেদের ব্যবস্থা নিজে করে নাও, তোমাকে তো নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, আবারও দৃঢ় কন্ঠ স্মিতার। আলাদা হয় সৌমেন কাকলি। স্মিতার সারাদিন নানা সমাজ সেবামূলক কাজে কাটে। মিসদিদা এত ভালোবাসা পায় যে একাকীত্ব অনুভব করে না স্মিতা। আর শেফালীরা তো আছেই। শুধু নাতনীর জন্য বড় মন কেমন করে।
‘একি দিদিভাই তুমি একা এখানে কি করে এলে? মা বাবাকে বলে এসেছো তো?’ মিতুনকে প্রশ্ন স্মিতার। নীচের ঘরে এসে স্মিতা দেখে মিতুন বসে আছে।
‘না কাউকে বলে আসিনি, কোচিং থেকে পালিয়ে চলে এসেছি”।
‘না না এটা ঠিক করোনি..’ অনেক চেষ্টা করেও সৌমেন বা কাকলিকে ফোনে পায় না স্মিতা।
ওদিকে সৌমেন কাকলির পাগলের মত অবস্থা, সময় পার হয়ে গেলেও মেয়ে আসছে না বলে। এতক্ষণে স্মিতা ফোনে সৌমেনকে পেলেন।
কাকলি সৌমেন গাড়ী নিয়ে এ বাড়িতে এসে মিতুনকে প্রচণ্ড বকাবকি। ‘চলো এক্ষুনি চলো..’
‘কিন্ত আমি যে কাজে এসেছি, তা তো এখনও হয় নি, আমি আজকের রাতটা এ বাড়িতে থাকবো, স্কুলে রচনা দিয়েছে ‘তোমার জীবনের আদর্শ নারী’ আমি যে ঠাম্মির কথাই লিখবো, ঠাম্মির ছোটোবেলা, ঠাম্মির জীবনের আরো অনেক কথা যে আমাকে জানতে হবে।’
‘কিন্তু সোনা তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান তোমাকে ছাড়া আমাদের থাকতে কষ্ট হবে যে, তুমি যখন মা হবে তখন বুঝবে বাবা মাকে কষ্ট দিতে নেই।’
কিন্তু স্কুলের মিস্ যে বলেন ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও।”সৌমেন কাকলি নিশ্চুপ, স্মিতা বা মিতুন কারুর চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতা নেই তাদের।